হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ، أَحَبَّ اللَّهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا."
"হোসাইন আমার থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে। যে তাকে ভালোবাসবে, সে আল্লাহকে ভালোবাসবে।"
(সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৪৪)
ইসলামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান ব্যক্তিত্ব, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক—ইমাম হোসাইন (আ.)। তিনি ছিলেন নবীজী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমাতুজ্জাহরা (আ.)-এর সুযোগ্য সন্তান। তাঁর জন্ম হয়েছিল ৩ শাবান ৪ হিজরিতে (৬২৬ খ্রিস্টাব্দ) মদিনায়। তাঁর আগমনে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং আল্লাহর নির্দেশে তাঁর নাম রাখেন "হোসাইন"।
ইমাম হোসাইন (আলাইহিস সালাম) শুধু কারবালার বীর নন, বরং তিনি ছিলেন ইবাদত ও আখলাকের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন শুধু বিপ্লব ও আত্মত্যাগের নয়, বরং নিরবচ্ছিন্ন এবাদত ও মহান চরিত্রের এক পরিপূর্ণ চিত্র। অনেকেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত ও কারবালার ঘটনার উপর বেশি জোর দেন, কিন্তু তাঁর গভীর এবাদত ও মহৎ চরিত্রের দিকটি তুলনামূলক ভাবে কম আলোচিত হয়। এই প্রবন্ধে আমরা সেই অনালোচিত দিকগুলোকেই তুলে ধরব।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এবাদত ও আত্মসমর্পণ:
ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ইবাদতের অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি সারা রাত নামাজে কাটাতেন, কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর কাছে অশ্রু ঝরিয়ে দোয়া করতেন। করবালার রণক্ষেত্রেও তিনি নামাজের প্রতি যত্নবান ছিলেন, যা আমাদের শিখিয়ে দেয়—কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া উচিত নয়।
তিনি বলেন,
"আমি এমন এক আল্লাহকে ভালোবাসি, যিনি আমার জন্য যথেষ্ট এবং আমার অন্তরকে প্রশান্তি দেন।"
এখানে একটি ঘটনার দিকে ইশারা করতে চাই।
কারবালার ঘটনার আগের রাত। শিবিরে অদ্ভুত এক পরিবেশ। একদিকে তলোয়ার ও যুদ্ধের প্রস্তুতি, অন্যদিকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শিবির থেকে ভেসে আসছে নামায ও মুনাজাতের সুর।
ইমামের একজন সাহাবি বর্ণনা করেন:
*"আমি গভীর রাতে ইমামের তাঁবুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন শুনতে পেলাম, তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করছেন। আমি তাঁবুর পর্দার আড়াল থেকে দেখলাম, তিনি সিজদায় পড়ে আছেন, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে, আর তিনি বলছেন:
'হে আমার প্রতিপালক! আমি একমাত্র তোমারই ওপর নির্ভরশীল। তুমি যদি আমার ইবাদত গ্রহণ করো, তবে এই দুনিয়ায় আর কিছুই আমার প্রয়োজন নেই!'"
এই ঘটনা আমাদের শিখিয়ে দেয়, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ইবাদত কেবল নিয়ম-রক্ষার জন্য ছিল না; বরং তা ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেম ও আত্মসমর্পণের প্রকাশ।
উত্তম আখলাক ও চারিত্রিক শিক্ষা:
১. সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচলতা:
করবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.) দেখিয়ে ছিলেন, সত্য কখনো মিথ্যার কাছে মাথা নত করে না। তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন যে,অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা যায় না।
নিচের ঘটনাটি প্রমাণ করে ইমাম (আঃ) সত্য ও ন্যায়ের প্রতি কতটা অবিচল ছিলেন।
কারবালার ৯ মহররম। যুদ্ধের আগের দিন। শত্রুপক্ষের সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শেষবারের মতো সমঝোতার প্রস্তাব পাঠায়। তারা বলে,
"আপনি যদি ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করেন, তাহলে জীবন রক্ষা পাবেন। দুনিয়ার সব সুখ-সুবিধা আপনাকে দেওয়া হবে।"
ইমাম হুসাইন (আ.) দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন,
"আমি কখনোই মিথ্যার কাছে মাথা নত করব না। আমি সত্যের পথেই জীবন দান করব, কিন্তু জালিমের সঙ্গে আপস করব না।"
শত্রুর দূত হতাশ হয়ে ফিরে গেল। রাতে ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর সঙ্গীদের একত্র করলেন এবং বললেন,
"আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। যদি তোমরা কেউ চলে যেতে চাও, তবে চলে যাও। শত্রুরা শুধু আমাকেই চায়। রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দেবে।"
কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা কেঁদে উঠলেন। তাঁরা বললেন,
"হে হুসাইন! আমরা আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। সত্য ও ন্যায়ের পথে আপনার সঙ্গে প্রাণ দিতেও আমরা প্রস্তুত।"
২. ক্ষমাশীলতা ও উদারতা:
তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও উদার। তাঁর শত্রুরাও তাঁর নৈতিকতা ও উদারতার প্রশংসা করত। এমনকি করবালার যুদ্ধের আগের রাতে তিনি তাঁর শত্রুদেরও পানি পান করিয়ে উদারতার সর্বোচ্চ নিদর্শন স্থাপন করেন।
ইমাম (আঃ) এর উদারতা এখানেই শেষ নয়, নিচের ঘটনাটা তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
একবার ইমামের একজন দাস একটি কাজ ভুল করে ফেলল। সে ভয় পেয়ে গেল এবং ইমামের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ইমাম তখন মৃদু হাসলেন এবং কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন:
"যারা রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।" (সুরা আলে ইমরান: ১৩৪)
এরপর ইমাম বললেন, "তোমাকে আমি শুধু ক্ষমাই করলাম না, বরং তুমি এখন থেকে মুক্ত।"
দাসটি আনন্দে কেঁদে ফেলল এবং বলল, "আমি কখনও এমন মহৎ মনিব দেখিনি!"
এই ঘটনা আমাদের শেখায়, ক্ষমা করা কেবল দুর্বলতার প্রকাশ নয়, বরং তা মহত্বের নিদর্শন।
৩. সবর ও ধৈর্য:
করবালার ময়দানে তিনি ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হয়েও ধৈর্য হারাননি। প্রিয়জনদের শাহাদাতের পরও তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।
নিচের ঘটনাটি প্রমাণ করে ইমাম (আঃ ) ছিলেন ধৈর্যের শ্রেষ্ঠ নমুনা।
এক ব্যক্তি একবার ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সামনে পেয়ে তাঁকে কটূক্তি করতে শুরু করল। ইমামের সঙ্গীরা রেগে গেলেন, কিন্তু ইমাম ধৈর্য ধরে বললেন, "ভাই, তুমি কি ক্ষুধার্ত? আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে খাওয়াবো। তুমি কি কোনো সমস্যায় আছো? বলো, আমি তোমার কষ্ট দূর করবো।"
লোকটি লজ্জিত হয়ে বলল, "আমি আপনাকে অন্যদের মতো মনে করেছিলাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আপনি রাসূলের প্রকৃত উত্তরাধিকারী।"
৪. পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ:
ইমাম হোসাইন (আ.) দেখিয়েছেন কীভাবে পরিবার, সমাজ ও উম্মাহর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনি নিজের জীবন দিয়ে ইসলামকে রক্ষা করেছেন, যা আমাদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে।
ইমাম (আঃ) এর ইবাদত ও আখলাকের শিক্ষা আমাদের জীবন কিভাবে নেওয়া উচিত?
ইমাম হোসাইন (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন, ইবাদত শুধু মসজিদে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকতে হবে। সত্যের পথে দাঁড়ানো, দুর্বলকে সাহায্য করা, শত্রুকেও ক্ষমা করা—এসবই ইবাদতের অংশ।
আমরা যদি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রকৃত অনুসারী হতে চাই, তবে শুধু তাঁর শোক পালন করলেই হবে না; আমাদের তাঁর এবাদত ও উত্তম আখলাককেও জীবনে ধারণ করতে হবে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ইবাদত, ধৈর্য ও উত্তম আখলাক অর্জন করার তৌফিক দান করো! আমিন।
আমাদের শিক্ষা:
১. সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা—কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা।
2. নম্রতা ও উদারতা চর্চা করা—ইমাম হোসাইন (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন বিনয় ও উদারতার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করা যায়।
3. ধৈর্য ও ত্যাগের গুণ অর্জন করা—জীবনের কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরার এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শিক্ষা নিতে হবে।
4. ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া—নামাজ, দোয়া ও কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা।
উপসংহার:
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জীবন শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি এক চিরন্তন আদর্শ। তাঁর চরিত্র ও শিক্ষা আমাদের জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকতে পারে। যদি আমরা সত্যিকারের হোসাইনি হতে চাই, তবে আমাদের উচিত তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা।
আসুন, আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি এবং সত্য, ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে রাখি। তাঁর মহত্ত্বপূর্ণ শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথনির্দেশনা দিক—এটাই হোক আমাদের দোয়া।
লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মি।
তারিখ: ০১/০২/২০২৫
আপনার কমেন্ট